বন্যা পরিস্থিতি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত অন্তর্বর্তী সরকার?
বন্যা পরিস্থিতি
গত ২৪ ঘন্টায় বন্যা দুর্গত অঞ্চলে প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার পানি কমতে দেখা
গিয়েছে। ফেনী, খোয়াই ও মনু নদীর তিনটি পয়েন্ট এ পানির স্তর বিপদসীমার নিচে
নামতে শুরু করেছে। এমনটাই জানিয়েছেন সেখানকার কর্মকর্তারা। এছাড়া কুশিয়ারা
নদীতে যে তিনটি পয়েন্ট এ বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো সেগুলোর
মধ্যে দিয়ে অন্ততপক্ষে দুটিতে রাতের মধ্যে পানি কমে স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে
আশ্বাস দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।
এদিকে, রোববার সকালের দিকে পানি বেড়ে যাওয়ায় রাঙ্গামাটির কাপ্তাই বাঁধ এর
সবগুলো গেট খুলে দিয়ে বিকেলের দিকে আবার সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে, এ
কাপ্তাই বাঁধ এর সবগুলো গেট খুলে দেওয়ার কর্মকর্তা জানিয়েছেন কর্ণফুলী নদীতে
পানি বাড়লেও নতুন কোনো এলাকায় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা একদমই নেই।
আরেক দিকে, সোমবার বিকেলে আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দিয়েছে উপকূলীয়
অঞ্চলগুলোতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এর। এতে করে চট্টগ্রাম এর মধ্যে বন্যা দুর্গত
এলাকার কোনো কোনো জায়গায় অবস্থা অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে বন্যা পূর্ব
আভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, পুনরায় বৃষ্টিপাতের কারণে
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি কিছুটা ধীরগতি হলেও অবনতির আশঙ্কা খুব একটা বেশি নয়।
বন্যার্তদের অবস্থা কেমন?
বিবিসি বাংলা সংবাদদাতারা এলাকা ঘুরে জানিয়েছেন যে, পানি কমতে শুরু করলেও এখনো
বাড়ি ফেরার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বন্যার্তদের। অনেকে ত্রাণ সহায়তা পেয়ে
থাকলেও বাজার থেকে দূরে বাড়ির ছাদে যারা আশ্রয় নিয়েছিলো তারা কোন ধরনের
সহায়তা পাননি এখন পর্যন্ত। তবে ফেনীর কিছু এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরে
এসেছে। যার কারনে তারা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। আত্মীয়
স্বজনদের খোঁজে কেউ কেউ আবার দুর্গত এলাকায়ও যাচ্ছেন। ফেনীর মতো কুমিল্লাতে
প্রায় একই রকম অবস্থা দেখা গেছে। তবে গোমতী এলাকার তীরবর্তী কিছু কিছু এলাকায়
বন্যা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত হয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ পানির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে জানুন
এদিকে, নোয়াখালীর স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েক জায়গায় পানি
সামান্য বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও মিরসরাইয়ে
পানি প্রায় কমে গিয়েছে। যার কারনে বেশিরভাগ বাসিন্দারা বাড়ি ফিরেছে। তবে
হাটহাজারীতে কিছু কিছু এলাকায় এখনো পানি বেশি রয়েছে। যার কারনে সেখানকার
বাসিন্দারা এখন পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। পানি নামতে শুরু করেছে
বটে তবে দূর বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের মধ্যে খাবারের সাথে সাথে তীব্র পানি
সংকট দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যে। এর পাশাপাশি গরু ছাগলসহ অন্যান্য পশু পাখির খাদ্য
সংকট অতিরিক্ত পরিমাণে দেখা দিয়েছে।
আরো পড়ুনঃ চুল পড়া বন্ধ করার তেলের নাম জেনে নিন
সরকারি তথ্যমতে জানা গেছে, গত কয়েকদিনের বন্যা পরিস্থিতিতে পূর্বাঞ্চল, উত্তর
পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের অন্ততপক্ষে প্রায় ১১ টি জেলা কবলিত হয়েছে। এর
মধ্যে ৪০ লাখ এরও বেশি মানুষ পানি বন্দী হয়ে রয়েছে। এই ১১টি জেলার মধ্যে
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ফেনী, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা ও মৌলভীবাজারের
মানুষ। ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গণনা করে জানিয়েছেন যে,
বন্যার্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মোট ১৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে ফেনীতে ১ জন,
চট্টগ্রামের ৫ জন, কুমিল্লায় ৪ জন, কক্সবাজারে ৩ জন, নোয়াখালীতে ৩ জন,
ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় ১ জন ও লক্ষ্মীপুরে ১ জন।
ভারী বর্ষণ রয়েছে যেসব স্থানে
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছেন, সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের
উপকূলীয় এলাকায় অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টিপাত শুরু
হয়ে গেছে যা সোমবার অব্যাহত থাকবে। রোববার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত
মোংলায় সর্বোচ্চ ৮১মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।এর বাইরে আবহাওয়া অধিদপ্তর রেকর্ড
করেছে, কক্সবাজারে ৪১ মিলিমিটার, চট্টগ্রামের ২৭ মিলিমিটার, খুলনায় ৬১ মিলিমিটার
ও বরিশালে ৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত।
বন্যা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না?
উপকূলীয় এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি যেহেতু উপরের দিকে আসবে না ফলে বন্যা
পরিস্থিতির উপর খুব একটা বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করা যায়। তবে
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছেন যে, পানি
উপরের দিকে না আসলেও চট্টগ্রাম বিভাগের বন্য পরিস্থিতির উন্নতির ক্ষেত্রে কিছুটা
ধীর গতি দেখা দিতে পারে। আবার যদি নতুন করে বেশি বৃষ্টিপাত হয় তবে খাগড়াছড়ি,
রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও ধীরে উন্নতি
হবে। সেক্ষেত্রে এসব অঞ্চলে বন্যার পানি তুলনামূলক অনেকটাই বেশি সময় ধরে থাকতে
পারে।
পানি কমতে কতদিন লাগবে?
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, সোমবার পর্যন্ত
বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে বলে জানা গেলেও মঙ্গলবার থেকে পুরোপুরি ভাবে পানি কমতে
শুরু করবে। কারণ, মঙ্গলবার থেকে পরবর্তী দিনগুলোতে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই
বললেই চলে।
প্রশ্ন হচ্ছে, পানি কমতে এত দেরি হওয়ার কারণ কি?
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, সাগরে জোয়ার আরো বেশি
বেড়ে গেছে তার কারণ পূর্ণিমা তিথির মধ্যে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে, নদনদীর
পানি নিষ্কাশনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি রয়েছে সেটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সব
মিলিয়ে পানি কমতে এত দেরি হচ্ছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে পানি পুরোপুরি নেমে যাবে
বলে আশা দিয়েছেন সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। তবে পানি নেমে যাওয়ার পরও
দুর্গত এলাকার অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের প্রস্তুতি কেমন?
বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর দুর্গত এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি পূরণের পাশাপাশি
রোগব্যাধির মোকাবেলা করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এবারও সেটির
ব্যতিক্রম হবে না বলে আশাবাদী রয়েছেন বন্যার্তদের সকলেই অন্তর্বর্তীকালীন
সরকারের কাছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ কামরুল হাসান
জানিয়েছেন, বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা তাদের রয়েছে। কাজেই
বন্যার পরে কি ধরনের পরিস্থিতি বা চ্যালেঞ্জ সামনে আসে এবং সেটি সঠিকভাবে
মোকাবেলা করতে হয় সেটি তারা জানে। অতীত অভিজ্ঞতার সাথে এবারে ফিল্ডের অভিজ্ঞতা
মিলিয়ে তারা বন্যা পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যাবতীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে
জানান মি. হাসান
আরো পড়ুনঃ মাথা ব্যাথা কমানোর ঔষধের নাম জেনে নিন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছেন, ডায়রিয়া, কলেরা সহ পানিবাহিত রোগ ও
অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ মেডিক্যাল টিম দুর্গত
এলাকায় ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। সামনে আরো কিছু টিম বন্যার্তদের
সহায়তায় তাদের সাথে যুক্ত হবে। মি. হাসান জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্থানীয়
হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা আক্রান্তদের সেবা দিবেন। এর পাশাপাশি দুর্গত এলাকায়
খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট মোকাবেলায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, আক্রান্ত জেলাগুলোর
প্রশাসনকে এক সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং তারা প্রস্তুতি নিতে চলেছে।
সেই সঙ্গে গবাদি পশু পাখির খাবারে যেন সংকট না পড়ে সেই ব্যবস্থাও নিতে বলা
হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস জানান,
মানুষের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ ইত্যাদির ক্ষয়
-ক্ষতির পরিমাণ নিরূপনের কাজ শুরু করবে সেগুলো পুনর্নির্মাণে প্রয়োজনীয় সাহায্য
সহযোগিতা করবে। বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই শনিবার দেশের ৪০টির বেশি বেসরকারি
উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। তিনি আহ্বান জানান, বন্যা পরবর্তী
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের সঙ্গে সকলকে একসাথে কাজ করার।